The Harappan Civilization

বিশ্বের প্রাচীনতম নগরসভ্যতাগুলির মধ্যে একটি হলো হারাপ্পা সভ্যতা বা সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতা। প্রায় চার হাজার বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশে এই সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। ১৯২১ সালে পাঞ্জাবের হারাপ্পা গ্রামে এবং ১৯২২ সালে সিন্ধুর মহেঞ্জোদারোতে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে এই সভ্যতার অস্তিত্ব প্রকাশ পায়। এই আবিষ্কার ভারতের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।

সময়কাল ও বিস্তার

হারাপ্পা সভ্যতা আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দ থেকে ১৫০০ অব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল। এটি বিস্তৃত ছিল সিন্ধু নদী ও তার শাখা নদীগুলির তীরে। বর্তমানে এই সভ্যতার বিস্তার দেখা যায় পাকিস্তান, গুজরাট, রাজস্থান, হরিয়ানা এবং পাঞ্জাবের বিভিন্ন অঞ্চলে।

প্রধান নগর

হারাপ্পা সভ্যতার বহু নগর আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—

  • হারাপ্পা (পাঞ্জাব, পাকিস্তান)
  • মহেঞ্জোদারো (সিন্ধ, পাকিস্তান)
  • কালীবঙ্গান (রাজস্থান, ভারত)
  • ধোলাভিরা (গুজরাট, ভারত)
  • লোথাল (গুজরাট, ভারত)

এই নগরগুলির প্রতিটিই তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের জন্য বিখ্যাত। যেমন, মহেঞ্জোদারো গ্রেট বাথের জন্য, লোথাল প্রাচীন নৌবন্দরের জন্য, আর কালীবঙ্গান অগ্নিকুণ্ড বা যজ্ঞকুণ্ডের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত।

নগর পরিকল্পনা

হারাপ্পা সভ্যতার অন্যতম বড় বৈশিষ্ট্য ছিল সুশৃঙ্খল নগর পরিকল্পনা

  • শহর দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল—
    1. দুর্গ বা সিটাডেল (Citadel) – উঁচু অংশ, প্রশাসন ও ধর্মীয় কার্যকলাপের কেন্দ্র।
    2. নিচু শহর (Lower town) – সাধারণ মানুষের বসতি।
  • সড়কগুলো সোজা ও সমান্তরাল ছিল এবং একে অপরকে সমকোণে ছেদ করত।
  • ঘরবাড়ি ছিল পোড়ামাটির ইটের তৈরি।
  • প্রায় প্রতিটি ঘরে কূপ, স্নানঘর ও নর্দমা ব্যবস্থা ছিল।
  • মহেঞ্জোদারোর গ্রেট বাথ ছিল বিশাল আকারের পুকুর, যা ধর্মীয় স্নানের জন্য ব্যবহৃত হত বলে ধারণা করা হয়।

অর্থনীতি

হারাপ্পা সভ্যতা মূলত কৃষিনির্ভর সমাজ ছিল।

  • প্রধান ফসল ছিল গম, যব, তিল, সরিষা, খেসারি ও তুলা।
  • তুলা উৎপাদনের প্রথম প্রমাণ এই সভ্যতা থেকেই পাওয়া যায়।
  • পশুপালনও ছিল গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত গরু, ভেড়া, ছাগল, মহিষ, হাতি ও উট।
  • শিল্প ও কারুশিল্পে তারা দক্ষ ছিল। মৃৎশিল্প, গয়না, ধাতব দ্রব্য, পুঁতির কাজ অত্যন্ত উন্নত মানের ছিল।
  • বাণিজ্য ছিল অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয়ই। মেসোপটেমিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
  • লোথাল ছিল একটি বিখ্যাত সমুদ্রবন্দর।

সমাজজীবন

হারাপ্পার সমাজজীবন ছিল বৈচিত্র্যময়।

  • ধনী-গরিব বিভাজন দেখা যায়।
  • নারী-পুরুষ উভয়েই অলঙ্কার পরিধান করত।
  • তুলার কাপড় প্রধান পোশাক হিসেবে ব্যবহৃত হত।
  • বিনোদনের জন্য পাশা খেলা ও সঙ্গীত প্রচলিত ছিল।

ধর্ম

ধর্মীয় বিশ্বাসে প্রকৃতি ও প্রতীকী দেবতার গুরুত্ব ছিল।

  • মাতৃদেবী পূজা প্রচলিত ছিল।
  • এক দেবতার মূর্তি পাওয়া গেছে, যাকে অনেকেই পশুপতিনাথ বা শিবের প্রাথমিক রূপ বলে মনে করেন।
  • গরু ও ইউনিকর্নের প্রতীক সিলমোহরে দেখা যায়।
  • কালীবঙ্গান থেকে অগ্নিকুণ্ডের সন্ধান পাওয়া গেছে।

লিপি ও ভাষা

হারাপ্পা সভ্যতার মানুষ একটি বিশেষ লিপি ব্যবহার করত, যাকে সিন্ধু লিপি বলা হয়।

  • এটি সিলমোহর, মাটির পাত্র ও অন্যান্য দ্রব্যে খোদাই করা ছিল।
  • তবে আজ পর্যন্ত এই লিপি পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি।

শিল্প ও সংস্কৃতি

হারাপ্পার মানুষ শিল্পে ছিল অত্যন্ত পারদর্শী।

  • মৃৎশিল্পে লাল মাটির উপর কালো নকশা আঁকা হত।
  • নৃত্যরত কুমারী (Dancing Girl) – ব্রোঞ্জের তৈরি বিখ্যাত ভাস্কর্য।
  • দাড়িওয়ালা পুরোহিত (Priest King) – পাথরের মূর্তি।
  • বিভিন্ন গয়না, পুঁতি, হাতির দাঁতের দ্রব্য তাদের শিল্পরুচির নিদর্শন।

অবসান

হারাপ্পা সভ্যতার পতনের কারণ আজও ইতিহাসবিদদের কাছে রহস্য। সম্ভাব্য কারণসমূহ—

  1. নদীর গতিপথ পরিবর্তন ও জলাভাব।
  2. প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন বন্যা বা ভূমিকম্প।
  3. অতিরিক্ত কৃষির ফলে মাটির উর্বরতা হ্রাস।
  4. বাইরের আক্রমণ, বিশেষত আর্যদের আক্রমণ।

উপসংহার

হারাপ্পা সভ্যতা মানব ইতিহাসে এক অসাধারণ অধ্যায়। উন্নত নগর পরিকল্পনা, উন্নত নিষ্কাশন ব্যবস্থা, কৃষি ও বাণিজ্যে অগ্রগতি এবং শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ—সবকিছুই প্রমাণ করে যে প্রায় চার হাজার বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশে এক উচ্চস্তরের নগরসভ্যতা গড়ে উঠেছিল। যদিও এর পতন রহস্যাবৃত, তবুও এই সভ্যতার নিদর্শন আজও আমাদের কাছে বিস্ময়কর।

Leave a Comment